নিজস্ব প্রতিবেদক:
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সালাম মকবুল উচ্চ বিদ্যালয়ে এক হৃদয়ছোঁয়া বিদায় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু কৃপাময় চন্দ্র চন্দ ২২ বছর ধরে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও গভীর দায়িত্ববোধ নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন। সেই দীর্ঘ সেবামূলক জীবনযাত্রার শেষে সোমবার (২৩ জুন) তাকে দেয়া হলো এক রাজকীয় সংবর্ধনা।
বিদ্যালয়ের হলরুমে দুপুর ১২টায় শুরু হয় বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষা অনুরাগী ব্যক্তিত্ব আব্দুস সালাম।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সালাম মকবুল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক হোসেন আহমদ। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, সাংবাদিক সৈয়দ রাসেল আহমদ এবং জুমন আহমদ, যাদের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে প্রাণসঞ্চার হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন শিক্ষার্থী জিয়াউল ইসলাম, এরপর পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জুলফা আক্তার ও ছাদিয়া বেগম পরিবেশন করেন হামদ ও নাত। ইসলামি সঙ্গীতে মুগ্ধতা ছড়ান ফাইয়াজ আহমদ। এ সময় পুরো পরিবেশে সৃষ্টি হয় এক আধ্যাত্মিক আবহ।
বিদায়ী শিক্ষক বাবু কৃপাময় চন্দ্র চন্দের প্রতি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে মানপত্র পাঠ করেন শাহ আলম ও শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার জুমি। বিদ্যালয়ের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অগ্রগতিতে কৃপাময় চন্দ্র চন্দের অবদানের বিস্তারিত তুলে ধরা হয় এতে।
বিদায়ী শিক্ষক কৃপাময় চন্দ্র চন্দ তার বক্তব্যে বলেন, “এই বিদ্যালয় শুধু আমার কর্মস্থল নয়, ছিল আমার দ্বিতীয় ঘর। এখানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ। আজ আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমার হৃদয় এখানে রয়ে গেল। শিক্ষার্থীদের চোখে স্বপ্ন দেখেছি, সহকর্মীদের সঙ্গে কাটিয়েছি বন্ধুত্বপূর্ণ সময়,সবকিছুর জন্য আমি কৃতজ্ঞ।” তার এ আবেগভরা বক্তব্যে অনেকের চোখে অশ্রু ঝরে।
প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের সদস্য সচিব সৈয়দ দিলোয়ার হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, “স্যার শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি শিক্ষার্থীদের একজন অবিভাবকও ছিলেন, আদর স্নেহ দিয়ে শিক্ষার্থীদের আগলে রেখেছিলেন। আজ তিনি অবসর নিচ্ছেন, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে আজীবন তিনি শিক্ষক হয়ে থাকবেন।”
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাকিবুল ইসলাম ও আবুল হোসেন তাদের বক্তব্যে স্মরণ করেন শিক্ষক কৃপাময়ের শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা ও শিক্ষার্থীদের প্রতি অসীম ভালোবাসার কথা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন একঝাঁক প্রাক্তন শিক্ষার্থী যারা নানা পেশায় প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ ছুটে এসেছেন তাদের প্রিয় শিক্ষককে বিদায় জানাতে। আবেগঘন ভাষায় স্মৃতিচারণ করেন রেদওয়ান হোসেন টিপু, হাবিবুর রহমান, ইয়াহইয়া আহমদ, বুশরা বেগম, মিলাদুর রহমান, হাদিকুর রহমান মান্না ও সোহেল আহমদ।
বর্তমান শিক্ষার্থীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তাহরিনা জান্নাত ফাতেমা, ইসরাত জাহান, মরিয়ম আক্তার মিম ও নাজমুল হোসেন সাকিব। তাদের চোখে ছিলো কৃতজ্ঞতা, কণ্ঠে ছিলো ভালোবাসা আর কথায় ফুটে উঠছিলো একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রভাব।
অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা প্রিয় শিক্ষককে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পরে দিনব্যাপী চলা এই আয়োজনে কবিতা আবৃত্তি, হামদ-নাত, স্মৃতিচারণ ও উপহার প্রদান ছিল উল্লেখযোগ্য। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হৃদ্যতা ও ভালোবাসার যে সম্পর্ক, তারই প্রতিচ্ছবি ছিল এই অনুষ্ঠান।
একজন শিক্ষকের অবসরে যাওয়া মানেই শেষ নয়,এটা এক নতুন যাত্রার সূচনা। বাবু কৃপাময় চন্দ্র চন্দ এই বিদ্যালয়ের ইতিহাসে থাকবেন একজন আলোকবর্তিকা হিসেবে, যিনি শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, হৃদয় দিয়ে গড়েছেন মানুষ।
বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে হোসেন আহমদ বলেন, বিদায় শব্দটি যদিও কষ্টের তবুও প্রকৃতির নিয়মে বিদায় জানাতে হয়। তবে এতটুকু বলতে চাই আজ শুধু আমরা যাকে বিদায় জানাচ্ছি, তিনি এই বিদ্যালয়ের একজন নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, দুর্ভাগ্যবসত স্যারের ক্লাস পাওয়ার সুযোগ হয়নি আমাদের, তার আগেই আমরা উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ফেলেছিলাম। তবে বিদ্যালয়ে আসলে স্যারের সাথে দেখা হলে, কথা বললে আফসোস করতাম যদি আমরা তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতাম কতই না ভালো হতো।