রুহুল আমিন:
কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ‘মব’ সহিংসতা। মবের কারণে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ উদ্বিগ্ন বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। গত ছয় মাসে ২৩০টি মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সহিংসতা, আন্দোলন, পিটিয়ে (মব) হত্যা, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, নারী ও শিশু নির্যাতন, কারাগারে মৃত্যুসহ নানান ঘটনায় কমপক্ষে ৪৬৮ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি নির্দেশ করে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতা, মবসহ বিভিন্ন গঠনায় কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় কমপক্ষে ৫০০জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২০০ জন।
অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব সহিংসতার পেছনে রাজনীতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যেখানে এই সহিংসতা দমনে দৃশ্যমান কোনো কঠোর পদক্ষেপ দেখাতে ব্যর্থ, সেখানে বিরোধী দলগুলোর ভেতর থেকেও বারবার এই সহিংসতা উসকে দেয়ার অভিযোগ উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, মব সমাজে বিদ্যমান নৈতিক অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা এবং সহিংস জনমতের উত্থানের উদ্বেগজনক চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত। এই ধরনের ঘটনা গোটা মানব জাতির মর্যাদার বিরুদ্ধে আঘাত। এই অপরাধের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি কঠোর অবস্থান না নেয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলার প্রতি জনগণের আস্থা আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। সামাজিক শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
দেশে মব সহিংসতা বা সংঘবদ্ধ অপরাধ বা গণপিটুনি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও এই সহিংসতায় প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। মব সহিংসতার শিকার হচ্ছেন পুলিশ, শিক্ষক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী ছাড়াও সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাদ যাচ্ছেন না বিদেশিরাও। বাসা-বাড়িতে লোকজন ঢুকে সবকিছু তছনছ করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সন্ত্রাসী নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন ‘তৌহিদি জনতা’। ফলে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ।
সম্প্রতি ভয়েস ফর রিফর্ম ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, মব সহিংসতার ঘটনা নিয়ে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ উদ্বিগ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও ঢিলেঢালা মনোভাবের সুযোগে একদল জনতা মব তৈরি করছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া মবের সুযোগ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে অন্যায় স্বার্থ হাসিল করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, আইন অবজ্ঞা করে মব সহিংসতার মাধ্যমে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি এবং ভয়াবহ পরিবেশ তৈরিতে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনা প্রচলিত আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য।
আসকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন পরায় ১০০ জন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন এবং ২০২০ সালে ৩৫ জন।
ভয়েস ফর রিফর্ম ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এক সমীক্ষার ফলাফলে জানা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। জরিপে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, জনগণের সংস্কার প্রত্যাশা এবং আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থন বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়। সমীক্ষায় দেখা যায়, নারীর নিরাপত্তা, রাতে চলাচলের নিরাপত্তা এবং পোশাক নিয়ে হয়রানি নিয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষের উদ্বেগ রয়েছে। ফলাফলে বলা হয়, সার্বিকভাবে মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগে ৮০ শতাংশ, নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে ৫৬ শতাংশ, রাতে চলাচলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে ৬১ শতাংশ মানুষ।
লেখক: রুহুল আমিন, ব্লগার
abidamin19941010@gmail.com